আজকের সময় প্রতিবেদক :
সারি সারি লেক। পানিতে মাছের লুকোচুরি। ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস সাঁতার কাটছে। ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির। লেকের ভাঁজে ভাঁজে খেজুর, পেঁপে, নারকেল, আনারস, আপেল, কমলা, মাল্টা আর লেবুগাছ। আছে কাজুবাদাম আর কফিগাছও। সুবাস ছড়াচ্ছে গোলাপ, গন্ধরাজ, শিউলি, অপরাজিতা, নীলকণ্ঠ, সাদাকণ্ঠ, মাধবীলতা, হাসনাহেনা, বেলি, রক্তকরবীসহ মনভোলানো ফুল। লেকের ওপর হাঁস-মুরগির খামার। আরেকপাশে গরু-মহিষ-ভেড়ার চাষ। চোখ জুড়াচ্ছে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। চারপাশ রঙিন করে তুলেছে সরিষা আর সূর্যমুখী। আছে নানা জাতের ঔষধি গাছ। কোথাও গাঢ় জঙ্গল, তাতে সারিবদ্ধ সবুজের মিতালি।
দেড় যুগ আগে দস্যুদের উৎখাত করে চরের নিয়ন্ত্রণ নেয় প্রশাসন। সেই খাস জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন ভূমিহীনরা। প্রায় ১৬৭ একর পতিত জমিতে ২০১৩-১৮ মেয়াদে ‘নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার এবং বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সরকার। নতুন করে ২০১৯ থেকে ২০২৪ মেয়াদে ‘ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার আধুনিকীকরণ এবং চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
এর ফলে গত ১০ বছরে দৃশ্যপট বদলে যায়। পতিত জমি হয়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। বিনামূল্যে ঘুরে দেখছেন কৃষির বৈচিত্র্য।
নোয়াখালী জেলা শহর থেকে সবুজে ঘেরা পিচঢালা সড়ক ধরে ৪০ কিলোমিটার গেলেই ভূইয়ারহাট এলাকায় বিএডিসির সুবর্ণচর ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার। দৃষ্টিনন্দন মূল ফটক থেকে ভেতরে ঢুকলেই খামারের অপার সৌন্দর্য দর্শনার্থীকে বিমোহিত করবে। খামারজুড়ে আছে ২০ হাজারেরও বেশি গাছ। নজর কাড়ে প্রশাসনিক ভবন ও সুবর্ণরেখা নামের আলিশান গেস্ট হাউস। সূর্য ডোবার পর নেমে আসে নীরবতা। শোনা যাবে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। জানালা খুললেই দেখা মিলবে শিয়ালের দলের। কানে বাজবে নানা পোকামাকড়ের আওয়াজ। জ্যোৎস্না রাত হলে অন্যরকম প্রকৃতি ধরা দেয়।
শীতকালে পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে পুরো এলাকা। ওপরে আকাশ আর নিচে সবুজের সমারোহ সৌন্দর্যের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। চওড়া ঢেউ খেলানো পাতার ভেতরে উঁকি দেয় ছোট-বড় নানা ফল। মিষ্টি গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। গাছে গাছে ঝুলছে হরেক ফল। ইট বিছানো পথে গাড়িতে ঘুরে দেখা যাবে দৃষ্টিনন্দন পুরো খামার।
সুবর্ণচরের বাসিন্দা সাবেক সচিব এটিএম আতাউর রহমান বলেন, এ খামারকে কৃষি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করার সময় এখনই। উপকূলের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে কৃষি পর্যটন। পাশাপাশি বিনোদন ও ভ্রমণের মাধ্যমে কৃষিপণ্যকে পরিচিত করানো যাবে। টিকিট কেটে যে আয় হবে সে অর্থ দিয়েই খামার চালানো যাবে। সরকার এদিকে দৃষ্টি দিলে চরাঞ্চলে নতুন কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। দেশের পর্যটন খাত ও অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা।
আরিফুর রহমান বলেন, খামারের পশ্চিমপাশে আরও বেশ কিছু পতিত খাস জমি আছে। সেগুলো কিছু প্রভাবশালী দখল করে নিচ্ছে। ওই জমিও খামারের আওতায় আনা গেলে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সম্প্রতি আমি দৃষ্টিনন্দন খামারটি ঘুরে এসেছি। এটি হতে পারে দেশের আদর্শ কৃষি পর্যটন কেন্দ্র। চরাঞ্চলের অর্থনীতি ভবিষ্যতে কৃষি পর্যটন দিয়ে চালিত হবে বলে আমি মনে করি।’
প্রকল্প পরিচালক আজিম উদ্দিন বলেন, ভবিষ্যতে নিজেদের আয়ে এ খামার চলবে বলে আশা। শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল ডাল ও তেলবীজ বর্ধন করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠেছে সমন্বিত কৃষি খামার। এখন পর্যন্ত নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর অন্তত দুই হাজার কৃষক এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রতি বছর ধান, ডাল, তেলসহ নানা জাতের অন্তত সাড়ে তিনশ টন বীজ উৎপাদন হচ্ছে। এ খামার থেকে বছরে অন্তত ৩ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। স্থানীয় বিলুপ্ত ফসল আবার কৃষকের হাতে পৌঁছে দিতে তারা কাজ করছেন।