Home » ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, ফেনী ও আগামীর বাংলাদেশ- সাংবাদিক এম. শরীফ ভূঞা

২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, ফেনী ও আগামীর বাংলাদেশ- সাংবাদিক এম. শরীফ ভূঞা

by ajkersomoy

২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, ফেনী ও আগামীর বাংলাদেশ

– সাংবাদিক এম. শরীফ ভূঞা

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল জনঅসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। সেটি শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়; বরং তা ছিল এক সামাজিক ঘুরে দাঁড়ানোর নাম।

ফেনীর তরুণ সমাজ, নাগরিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের ভূমিকায় এ আন্দোলন পেয়েছে একটি ইতিবাচক রূপ।

এখন সময় এসেছে এই চেতনার ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার।
যেখানে থাকবে না দমন-পীড়ন, থাকবে না দুঃশাসন। থাকবে স্বচ্ছতা, সম্মান ও সংলাপ।
২০২৪ সাল—বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাঁকবদলের বছর। নির্বাচনী প্রক্রিয়া, গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক অনিয়মের বিরুদ্ধে মানুষের যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা অনেকটাই গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল। রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত মানুষের কণ্ঠে একটাই সুর—জবাবদিহি চাই, স্বচ্ছতা চাই, অধিকার চাই।

এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা ফেনী একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে। রাজনৈতিক সচেতনতা, তরুণ প্রজন্মের সোচ্চার অংশগ্রহণ এবং সাংগঠনিক শক্তির কারণে ফেনী ২০২৪-এর গণআন্দোলনের এক বলিষ্ঠ মঞ্চে পরিণত হয়।

বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। অভিযোগ ওঠে অংশগ্রহণহীন নির্বাচন, প্রশাসনিক পক্ষপাত ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বেকার সমস্যা, দুর্নীতি এবং সরকারি সেবার অকার্যকারিতা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

এই বিক্ষোভ বা আন্দোলনকে অনেক বিশ্লেষক ‘আধুনিক যুগের গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবে দেখেছেন। কারণ, এটি ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ, সংগঠিত এবং নাগরিক দাবির ভিত্তিতে পরিচালিত।

নিরব বিপ্লবের শহর ফেনী একসময় ছিল মফস্বলের নিভৃত জনপদ। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভাষা আন্দোলন হোক কিংবা মুক্তিযুদ্ধ, কিংবা ১৯৭৪ সালের ১৭ জুলাইয়ের ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’, ফেনী তার প্রতিরোধের পরিচয় রেখে এসেছে বারবার।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানেও ফেনী থেমে থাকেনি। শহরের প্রাণকেন্দ্র মহিপাল, ট্রাংক রোড, রেল স্টেশন এলাকা থেকে শুরু করে দাগনভূঁইয়া, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া—সব জায়গায়ই দেখা যায় নাগরিক প্রতিবাদ।

তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত শিক্ষার্থীরা, প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদে নামে।
তাদের কণ্ঠে ছিল কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সুশাসনের দাবি।
তারা রাস্তা বন্ধ করেনি, গাড়ি ভাঙচুর করেনি; কিন্তু মানববন্ধন করেছে, তথ্যভিত্তিক স্লোগান দিয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়েছে।

নেতৃত্ব ও সংগঠনের দিক
ফেনীর গণপ্রতিরোধকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এটি ছিল সুসংগঠিত ও সচেতন নেতৃত্বের ফল। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক পরিষদ, ছাত্রসংগঠন ও সামাজিক সংগঠনগুলো শিক্ষিত, নিরপেক্ষ ও চিন্তাশীল নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে।

তরুণরা শুধুই ক্ষোভ নয়, বিকল্প চিন্তাও তুলে ধরেছে। অনেক জায়গায় তারা “অধিকার হোক আলোচনার বিষয়”—এই স্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজন করেছে ওপেন ডায়ালগ, ক্যাম্পাস টক, এবং ভিডিও কনটেন্টের।

এই ধরণের সচেতন প্রতিরোধই প্রমাণ করে, ফেনী কেবল সমস্যার কথা বলে না, সমাধানের দিকও দেখাতে চায়।

সম্ভাবনার ফেনী: আগামীর মডেল। যদি স্থানীয় স্তরে সচেতনতা, সংগঠন ও অংশগ্রহণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা যায়, তবে ফেনী হতে পারে বাংলাদেশের একটি নেতৃত্বদায়ী মডেল জেলা। এর জন্য প্রয়োজন:

তরুণদের জন্য প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ:
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, স্টার্টআপ ইনকিউবেটর এবং ফ্রিল্যান্সিং একাডেমি স্থাপন করা জরুরি।

নতুন শিক্ষাব্যবস্থা:
বাস্তবমুখী কারিকুলাম, গবেষণাভিত্তিক শিক্ষায় ফেনীকে একটি আঞ্চলিক শিক্ষা-হাব বানানো সম্ভব।

স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি:
জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাজ মনিটর করার জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে করে গণতান্ত্রিক চর্চা আরো গভীর হবে।

কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ উন্নয়ন:
ফেনীর গ্রামীণ অঞ্চল যেমন দাগনভূঁইয়া ও ফুলগাজীতে আধুনিক কৃষি ও হিমাগার স্থাপন করে কৃষকের আয় বাড়ানো সম্ভব।

রাজনীতি নয়, নাগরিক অধিকারই মূল। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষা হলো—মানুষ রাজনীতি করতে চায় না, মানুষ অধিকার চায়। তারা চায়—ভোট দিতে, কর্মসংস্থান পেতে, নিরাপদে চলতে।

ফেনীর তরুণ সমাজ এটি ভালোভাবেই বুঝেছে। তারা দলীয় পরিচয়ের চেয়ে নাগরিক পরিচয়কে বড় করে দেখছে। এই পরিবর্তন ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।

ফেনী যদি জাগে, বাংলাদেশ বদলাতে বাধ্য।
গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি আন্দোলনের ধারা, একটি সচেতন সমাজের আত্মপ্রকাশ।

লেখক: সম্পাদক, আজকের সময়, সাধারণ সম্পাদক, ফেনী সাংবাদিক ইউনিটি।

আরো খবর