Home » শিক্ষকতা শুধু একটা পেশা নয় এটা একটি মহান ব্রত

শিক্ষকতা শুধু একটা পেশা নয় এটা একটি মহান ব্রত

by আজকের সময়

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ নয়ন :

পৃথিবীতে নানা ধরনের পেশা আছে, একাডেমিক পড়াশোনা শেষে এক একজন এক এক পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সব পেশায় সম্মানী পাওয়া গেলেও সমান ভাবে সম্মান পাওয়া যায় না। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে শিক্ষকতা পেশা। শিক্ষকতা পেশায় সেবা বা শিক্ষা গ্রহণ করার পর ও ঐ শিক্ষককে আমৃত্যু সবাই সম্মান করে। অন্য পেশার ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণ করার পর আর সেবা দাতাকে তেমন সম্মান করে না। একজন শিক্ষককে সর্বস্তরের মানুষ সম্মান করে। শিক্ষকদেরই একমাত্র স্যার বলে সম্বোধন করা যায়। অন্য পেশাতে সেই সুযোগ নেই। একজন শিক্ষক একটি পরিবারের আলোর প্রদীপ এর মত,শিক্ষকের মাধ্যমে শত শত পরিবারের স্বপ্ন তৈরি হয়। একজন অভিভাবক তার স্বপ্ন গুলো শিক্ষকের হাতে তুলে দেন আর শিক্ষক সেই স্বপ্নকে লালন করে বড় করেন,ঐ পরিবারে আলোর প্রদীপ তৈরি করেন। তাদের স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়ন করেন। আর পরিবার গুলোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলে শিক্ষক যে রকম তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ করেন তা অন্য কোন পেশাতে পাওয়া যায় না।

একজন শিক্ষক তার শিক্ষকতা জীবনে অনেকের জীবনে আলোর প্রদীপ জ্বালাতে পারেন,অনেকে শিক্ষকের আদর্শ ধারণ করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে কিন্তু শিক্ষক তার ঐ জায়গাতে থেকে যান। বলা যায় শিক্ষক হচ্ছে রাস্তার মত,রাস্তা যেমন একই জায়গায় থেকে পথিকদের কে তার গন্তব্যে পোঁছিয়ে দেয়,তেমনি শিক্ষক ও একই অবস্থায় থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোর শিখা জ্বালিয়ে তার গন্তব্যে নিয়ে যায়। এতে শিক্ষকের আর্থিক কোন লাভ না হলেও এর মধ্যে কিন্তু শিক্ষকের একটা গর্ব বোধ কাজ করে। আমার শিক্ষকতা জীবনে এই অল্প সময়েও যখন দেখি আমাদের ছাত্র ছাত্রীরা এসএসসি, এইচএসসি পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পায়ে দেখা করতে আসে তখন আমাদের মন গর্বে ভরে উঠে। তখন শিক্ষকতা পেশার প্রতি নিজের ভালোবাসা বেড়ে যায়। এই সম্মান অন্য কোন পেশার মধ্যে দেখা যায় না।

একজন আদর্শ শিক্ষকের ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে তার শিক্ষকতা, কিভাবে তিনি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করবেন তার চিন্তা করা। তিনি তার সময় ও দায়িত্ব বোধ সম্পর্কে সচেতন থাকেন। অন্য পেশার বেশির ভাগ লোক প্রোডাক্ট তৈরি করে আর একজন শিক্ষক মানুষ তৈরি। এই জন্য শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগরি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ছোট ছোট কচি ফুলের মত শিশুদেরকে আগামীর সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে। যেখানে মা-বাবা, দাদা-দাদী বা অন্য আত্মীয় স্বজন মিলে একজন শিশুকে মানুষ করতে সময় দেয়,সেখানে একজন শিক্ষক ৪+ বা ৫+ বয়সী প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির ২০/৩০ জন শিক্ষার্থীকে এক সাথে গড়ে তুলে আপন স্নেহ ও ময়া মমতায়।

একজন শিক্ষক বেতন হিসাব করে কাজ করেন না। তিনি যে বেতন পান তার থেকে অনেক বেশি কাজ করেন। যে বেতন পান তাদিয়ে হয়তো নিজে ও সন্তানদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে পারেন না, কিন্তু ঠিকই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উন্নত স্বপ্ন দর্শনে উদ্ভুদ্ধ করেন। তিনি পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে কাজ করেন। তিনি যে বেতন পান তা দিয়ে স্মার্ট ভাবে চলা সম্ভব না,তবুও তিনি নিজের মনের আনন্দে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিতরণ করেন। শিক্ষাকে যদি বলা মেরুদণ্ড,শিক্ষক হচ্ছেন সেই মেরুদণ্ড তৈরির হাতিয়ার।

শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানব জাতির ভবিষ্যতের রূপকার। শিক্ষক সম্পর্কে বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) বলেছেন আমাকে শিক্ষক হিসেবেই পেরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ব নবী (স:) ও একজন শিক্ষক ছিলেন। এছাড়াও অনেক মনিষী ও দার্শনিক শিক্ষকতা করেছেন ও এই পেশাকে নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন- নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজায় বলেন- ” আমাদের মনে রাখতে হবে: একটি বই,একটি কলম,একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। একজন শিক্ষক সমাজের সর্বত্র প্রভাব পেলতে পারেন,কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হিয়। উইলয়াম আর্থার ওয়ার্ড শিক্ষকতা সম্পর্কে বলেন মাঝারি মানের শিক্ষক বুঝিয়ে দেন,শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান ও মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন। আমাদের শিক্ষকরা আমাদের বন্ধু,দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই নয়, শিক্ষকদের থেকে যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন করি, তা জীবনের বাকি দিনগুলোতে বহন করে থাকি আমরা।

এত অর্জন ও সম্মান থাকার পর ও শিক্ষাতা পেশায় কিছু বৈষম্য রয়েছে। বেতনের বৈষম্য, পদের বৈষম্য, পদোন্নতির বৈষম্য। একজন চাকুরীজীবি পেশাগত জীবনে ধাপে ধাপে পদোন্নতির ব্যাবস্থা থাকলে তার কর্মস্পীহা ও আত্মমর্যাদা বাড়ে। সরকারের বিভিন্ন সেক্টর তা বিদ্যামান থাকলে তা প্রাথমিকে বন্ধ রয়েছে। একজন শিক্ষক ২৮/৩০ বছর চাকুরী করে ও একই পদ থেকে বিদায় নেন। একই যোগ্যতা, একই সিলেবাস, একই কারিকুলাম, একই শিক্ষার্থীদের কাজ করা পিটিআই সংলগ্ন পরিক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১০ম গ্রেড আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ১৩ তম গ্রেড। এ সকল বৈষম্যের কারণে শিক্ষকদের কর্ম জীবন উপেক্ষিত, মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না,আসলে ও আরো ভালো সুযোগ পেলে চলে যায়।

শিক্ষকদের এই সকল বৈষম্য নিরসনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন অভাব নেই,অভাব শুধু এর প্রতিফলন ও বাস্তবায়নে। এ সকল সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষতার মত মহান পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই একজন আদর্শ শিক্ষকের স্পর্শে এসে প্রতিটি শিক্ষার্থী আলোকিত করুক তার জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে।

লেখক: মুহাম্মদ আবদুল্যাহ নয়ন।
শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা।

আরো খবর